ঢাকা,শুক্রবার, ১৫ নভেম্বর ২০২৪

জাফরকে জেলা আ’লীগ: ১৫ টি অভিযোগের বিষয়ে কারণ দর্শানোর নোটিশ

কক্সবাজার রিপোর্ট :
নানাবিধ সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের কারনে চকরিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি জাফর আলমকে কারন দর্শানোর নোটিশ দিয়েছে কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগ। নোটিশে জেলা আওয়ামী লীগের ১১ জন নেতার লিখিত অভিযোগ, অপরাধজনক কাজকর্ম, সংগঠন বিরোধী কার্যকলাপসহ নানাবিধ সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের ১৫ টি অভিযোগের বিষয়ে জবাব চাওয়া হয় জাফর আলমের কাছে।
গত ১ জুলাই অনুষ্ঠিত জেলা আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সংসদের সভার সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত অনুসারে ওই নোটিশ দেওয়া হয়েছে। জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মুজিবুর রহমান স্বাক্ষরিত নোটিশটি কুরিয়ারযোগে পাঠানো হয় গত ৫ জুলাই। নোটিশ প্রাপ্তির সাত দিনের মধ্যে জাফর আলমকে প্রতিটি অভিযোগের দফা অনুসারে জবাব দিতে বলা হয়েছে। অন্যথায় তাঁর বিরুদ্ধে পরবর্তী সাংগঠনিক ব্যবস্থা তথা সাময়িকভাবে বহিস্কারসহ কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের অনুমোদন সাপেক্ষে যাবতীয় ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে বলেও জানানো হয়। প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহনের জন্য নোটিশের অনুলিপি পাঠানো হয়েছে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় দপ্তরে। জাফর আলম গতকাল মঙ্গলবার পর্যন্ত নোটিশের কোন জবাব পাঠাননি।
নোটিশে এক নম্বর অভিযোগে বলা হয়েছে, জাফর দীর্ঘদিন ধরে ধারাবাহিকভাবে একের পর এক অপরাধজনক ও সংগঠন বিরোধী কার্যকলাপে জড়িত রয়েছেন। যেমন ব্যক্তি মালিকানাধীন চিংড়ি প্রকল্পের জবর দখল, চিংড়ি প্রকল্প হতে ব্যাপক চাঁদাবাজি, ডাকাত বাহিনী লালন-পালন, কুখ্যাত অপরাধী চক্র ও অস্ত্রধারীদের নেতৃত্ব প্রদানসহ মারাত্মক অপরাধ সংগঠনের ব্যাপারে অভিযোগ রয়েছে। যার কিছু কিছু প্রমান জেলা আওয়ামী লীগসহ স্থানীয় প্রশাসনের হাতে রয়েছে।
দুই নম্বর অভিযোগে বলা হয়, অপরাধ জগত নিয়ন্ত্রনের বিষয় নিয়ে চকরিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক গিয়াস উদ্দিন এর সাথে তাঁর (জাফরের) অনেক জগন্য ঘটনা সংগঠিত হয়। শাহ ওমর (রা:) এর দরগাহ প্রাঙ্গনে গিয়াস উদ্দিন আহুত মতবিনিময় সভায় তাঁর নেতৃত্বে সন্ত্রাসী বাহিনী ব্যাপক গালিগালাজ করে নেতাকর্মীদের মারধর করেছেন এবং খাদ্য সামগ্রী নালার মধ্যে ফেলে দিয়েছেন, ডেকোরেটর্স এর মালামাল ভাংচুর করেছেন। সর্বোপরি তিনি দরগাহ শরীফে বেয়াদবী করেছেন। এই বিষয়ে জেলা আওয়ামী লীগের কাছে তথ্যপ্রমানসহ গিয়াস উদ্দিন পক্ষের অভিযোগ ও আবেদন সংরক্ষিত আছে।
তৃতীয় অভিযোগে বলা হয়, বিগত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে বিদ্রোহী প্রার্থী দিয়ে তিনি দলীয় প্রতিকের অনেক চেয়ারম্যান পদপ্রার্থীদের সন্ত্রাসের মাধ্যমে পরাজিত করেছেন এবং বিএনপি-জামায়াত প্রার্থীদের বিজয়ে সহায়তা প্রদান করেছেন। জেলা আওয়ামী লীগের সাহসী ও কঠোর ভূমিকার কারনে দলীয় বিজয়ী প্রার্থীদের বিজয় সুনিশ্চিত হয়েছে।
চার নম্বর অভিযোগে বলা হয়েছে, বিভিন্ন ধরনের মারাত্মক অপরাধ ও সংগঠন বিরোধী কর্মকান্ডের কারনে তাঁর বিরুদ্ধে গত ২০১৬ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর আরো একবার কারন দর্শানোর নোটিশ প্রদান করা হয়েছিল। ঘটনার বিষয়ে দু:খ প্রকাশ করায় এবং সংগঠনের ঐক্যের স্বার্থে এবং সংশোধন হয়ে যাবেন এই নিশ্চয়তা প্রদান করায় তাঁর বিরুদ্ধে পরবর্তী সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহন করা হয়নি। বিস্ময়ের সাথে লক্ষ্য করা যাচ্ছে, তিনি সংশোধন হননি বরং পূর্বের চেয়ে আরো মারাত্মক ও ভয়াবহ রূপে অপরাধ করে যাচ্ছেন যা সরকার জনস্বার্থ ও সংগঠনের জন্য মারাত্মক হুমকি বয়ে আনছে।
পাঁচ নম্বর অভিযোগে বলা হয়, চকরিয়া উপজেলা এলাকায় সংগঠনের শোচনীয় অবস্থা, দলীয় কোন্দল, ইউনিয়ন সংগঠনের অচলাবস্থা, স্থানীয় ভোটার ও জনগনে বিরুপ মনোভাব ইত্যাদি বিষয় বিবেচনায় তা নিরসন করে দলকে সুসংহত, সুশৃংখল, শক্তিশালী ও গণমুখী করার প্রত্যয়ে অন্যান্য উপজেলার মত চকরিয়া উপজেলায়ও জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক টিম উপজেলা আওয়ামী লীগকে সহায়তা করার জন্য দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল যাতে সংগঠনের প্রাণ ফিরে আসে এবং আওয়ামী ভোট ব্যাংক বৃদ্ধি পায়। কিন্তু তিনি পদে পদে ওই সাংগঠনিক টিমের বিরোধীতা করেছেন এবং তাদেরকে বাধাগ্রস্ত করেছেন। তিনি সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদ বিরোধী কমিটিকেও চকরিয়ায় কাজ করতে দেননি।
নোটিশের ছয় নম্বর অভিযোগে বলা হয়েছে, জাফর আলম দলীয় ভাবমুর্তি ক্ষুন্ন করে প্রবাহমান মাতামুহুরী নদীতে বাঁধ দিয়ে প্রায় তিনশ’ একর জলাভূমি অবৈধভাবে মৎস্য চাষ করেছেন। যার ফলে হাজার হাজার ঘরবাড়ি বন্যায় প্লাবিত হচ্ছে এবং লক্ষাধিক মানুষ তাতে ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখিন হচ্ছে। বিষয়টি আইন শৃংখলা কমিটি ও জেলা উন্নয়ন সমন্বয় কমিটিতে বারবার উত্থাপিত হচ্ছে। জেলা প্রশাসন বিষয়টি নিয়ে খুবই বিব্রতকর অবস্থায় আছেন।
সাত নম্বর অভিযোগে বলা হয়, এলাকায় ব্যাপকহারে খুন-খারাবিসহ অপরাধ উদ্বেগজনকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে, অস্ত্র উদ্ধারও হচ্ছে। বিশ^স্থ সূত্রে অভিযোগ আছে, তাঁর বিরুদ্ধে এবং প্রত্যেকটি বিষয় পর্দার অন্তরালে জনগন আপনার ছবি দেখতে পাচ্ছে। ভয়ে প্রকাশ্যে কেউ বিরোধীতা করার সাহস পাচ্ছে না বলে আইন শৃংখলা রক্ষাকারী সংস্থা সমূহ বিষয়টুকু আমলে নিতে পারছে না। অথচ বিষয়গুলো অনেকেই জানে। তারপরও অন্তরালে থেকে যাচ্ছে।
আট নম্বর অভিযোগে বলা হয়েছে, বিগত জেলা পরিষদ নির্বাচনে জাফর প্রকাশেই দলীয় প্রার্থী মোস্তাক আহমদ চৌধুরীর বিরোধীতা করেছেন। যা মোস্তাক আহমদ চৌধুরী জেলা আওয়ামী লীগের সভায় তার বক্তব্যে উল্লেখ করেছেন।
নয় নম্বর অভিযোগ বলা হয়, কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান লে: কর্ণেল (অব:) ফোরকান আহমেদ এলাকায় গরুচুরিসহ অপরাধ বৃদ্ধির কারণ হিসেবে জাফর আলমকে ইঙ্গিত করেছেন।
নোটিশের দশ নম্বর অভিযোগে বলা হয়েছে, জুন মাসের আইন শৃংখলা কমিটির সভায় স্থানীয় সংসদ সদস্যসহ সাংবাদিক, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, মুক্তিযোদ্ধা ও উপস্থিত কর্মকর্তাবৃন্দ চিংড়ি জোনে ডাকাতি, চাঁদাবাজি, লুটতরাজ ও অস্ত্রের ব্যবহারে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে জাফর আলমকে দোষারোপ করেছেন। সভার রেজুলেশন এই বিষয়ে প্রমান দেবে।
১১ নম্বর অভিযোগে বলা হয়, বিএনপি জামায়াতের পক্ষে নিয়ে তিনি আওয়ামী পরিবারের সদস্যসহ আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে থানায় মিথ্যা মামলা নিতে চাপ প্রয়োগ করেছেন। মিথ্যা মামলা হয়েছে অনেক। সবগুলোর নেপথ্যে জাফর আলম আছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। পেকুয়া থানার মগনামার ঘটনাপ্রবাহ এই বিষয়ে প্রকৃষ্ট উদাহারন।
১২ নম্বর অভিযোগে বলা হয়, চিংড়ি জোনে নুরুল আমিন হত্যাকান্ড ও আতাউল্লাহ হত্যাকান্ডে সরাসরি জাফর আলম জড়িত বলে বিস্তর বিস্তর অভিযোগ আছে।
১৩ নম্বর অভিযোগে বলা হয়েছে, জাফর আলমের সাথে জেলা আওয়ামী লীগের সিনিময়র সহ-সভাপতি এডভোকেট আমজাদ হোসেন আলাপ আলোচনা করে কক্সবাজার-১ সংসদীয় আসনের ইফতার মাহফিল দেওয়া হলেও তিনি সরাসরি তার বিরোধীতা করেছেন এবং অনেক নেতাকর্মীকে ইফতার মাহফিলে যেতে দেননি। অথচ সেই ইফতার মাহফিলে জেলা আওয়ামী লীগের প্রায় দুই ডজন নেতৃবৃন্দসহ হাজার হাজার নেতাকর্মী উপস্থিত ছিলেন।
নোটিশের ১৪ নম্বর অভিযোগে বলা হয়, জাফর চকরিয়া, পেকুয়া এলাকায় আওয়ামী লীগ সভাপতি সাধারণ সম্পাদকসহ জেলা আওয়ামী লীগ নেতার পরামর্শ, সাংগঠনিক কর্তৃত্ব, তদারকি বা উপস্থিতি সহ্য করতে পারেন না। তিনি নিজেকে ওই এলাকায় একচ্ছত্র রাজা বলেই ঘোষনা দিয়ে যাচ্ছেন। বিকৃত ব্যাখ্যা দিয়ে নেতাকর্মীদের উত্তেজিত করতে চেষ্টা করে যাচ্ছেন। অন্যান্য উপজেলাতেও আপনি উত্তেজনা ছড়ানোর অপচেষ্টায় লিপ্ত রয়েছেন। তাই এই সকল কর্মকান্ডে দলীয় শৃংখলা ও দলীয় ভাবমুর্তি, ঐক্য ব্যাপকভাবে বিনষ্ট হচ্ছে।
সর্বশেষ ১৫ নম্বর অভিযোগে বলা হয়েছে, জাফরের চকরিয়ার কমিটি মেয়াদোত্তীর্ণ। ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড কমিটি সমূহ ৭/৮ বৎসরের মেয়াদোত্তীর্ণ ও প্রায় ক্ষেত্রেই অচল। কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের নির্দেশনা অনুযায়ী ওয়ার্ড সম্মেলন, ইউনিয়ন সম্মেলন করার নির্দেশনা জেলা আওয়ামী লীগ থেকে দিলেও এই যাবত তিনি কোন উদ্যোগ গ্রহন করেননি। বরং অশালীনভাবে তার বিরোধীতা করেছেন এবং করে যাচ্ছেন। এটা শিষ্টাচার ও সাংগঠনিক শৃংখলা বহির্ভূত।
এ বিষয়ে জানতে গতকাল রাতে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে চকরিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি জাফর আলম বলেন, ‘জেলা আওয়ামী লীগের কোন নোটিশ আমি এখনও হাতে পাইনি। বন্যা কবলিত এলাকায় ত্রাণ নিয়ে ছুটে বেড়াচ্ছি। রীতিমতো দৌড়ের উপর সময় কাটছে। যদি নোটিশ পাই তবে অবশ্যই আমি এর জবাব দেব। জেলা আওয়ামী লীগ যেকোন বিষয়ে আমাকে কোয়ারি করতেই পারে। আবার জেলা আওয়ামী লীগকেও কোয়ারী করতে পারে উপরের সংগঠন। সংগঠন তো জেলা আওয়ামী লীগ চালায় না। চালায় নেত্রী শেখ হাসিনা।’
তিনি বলেন, ‘জেলা আওয়ামী লীগের সাথে আমার কোন বিরোধ নেই। এখানে সমস্যা হলো, সাংগঠনিক টিম ক্ষমতার অপব্যবহার করছে। তারা নিয়ম বহির্ভুতভাবে আমাকে বাদ দিয়ে অসাংগঠনিক তৎপরতা চালাচ্ছেন। সাংগঠনিক টিমের এই অসাংগঠনিক তৎপরতার বিষয়টি আমি কেন্দ্রে অবহিত করেছি।’ তথ্য সূত্র : দৈনিক কক্সবাজার ।

পাঠকের মতামত: